নিজস্ব প্রতিনিধি
ফরিদপুর জেলার চরভদ্রাসন উপজেলার পদ্মা নদীর গোপালপুর ফেরী ঘাট, ওপারে দোহার এলাকার চরমইনুট ঘাট। ফরিদপুর তিন উপজেলার কয়েক লক্ষ মানুষ ঢাকা যাওয়া আসার জন্য এই রুটটি ব্যবহার করে থাকেন। এলাকাবাসীর সুবিধার্থে ফরিদপুর ৪ আসনের সংসদ সদস্য মুজিবুর রহমান নিক্সন চৌধুরী এই রুটে ফেরী চালুর উদ্যোগ নিয়েছেন। প্রথমে তিনি সড়ক ও জনপথ বিভাগের ফেরী চালু করার চেষ্টা করেন, কিন্ত আইনী জটিলতায় সেটি চালু করা না গেলেও এমপি নিক্সন চৌধুরী অভ্যান্তরীন নৌ চলাচল কতর্ৃপক্ষের মাধ্যমে এখানে ফেরী চালুর উদ্যোগ নেন। এবছরের মধ্যেই ফেরী চালুর কথা রয়েছে এই রুটে।
এদিকে বর্তমানে এই নৌ রুটে পারপারের জন্য মাধ্যম রয়েছে ট্রলার ও স্পিডবোট। যেখানে যাত্রীরা ঘাট ইজারাদারের কাছে জিম্মি, হয়রানীর শিকার। বাধ্য হয়ে ইজারাদার কতর্ৃপক্ষের চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হয় যাত্রীদের। খোজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিদিন গড়ে হাজার খানেক মানুষ এই রুটে পদ্মা পাড় হয়।
সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, এখানে পদ্মা পাড় হতে স্পিডবোটে সময় লাগে ১৮ মিনিটের মত আর ট্রলারে ঘন্টাখানেক। ১৮ মিনিটের এই যাত্রায় ঘাট ইজারাদার স্পিডবোটের যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। সন্ধ্যায় এবং আবহাওয়া খারাপ হলে এই ভাড়া দ্বিগুন, তিনগুন পর্যন্ত হয়ে যায়। অপর দিকে ট্রলার ভাড়া নেয়া হয় ১৬০ টাকা করে। যাত্রীদের অভিযোগ দেশের অন্যান্য ঘাটের তুলনায় এই ভাড়া অনেক বেশী। অভিযোগ, স্থানীয় প্রশাসনের হুশিয়ারি ও ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনার পরও কমছে না ইজারাদারের দৌরত্ব।
যাত্রীদের অভিযোগ, নানা অযুহাতে এখানে ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়। বোটে নেই পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেট, যাও বা আছে তা নোংরা, অস্বাস্থ্যকর। প্রতি ঈদে যাত্রীদের জিম্মি করে কয়েকগুন পর্যন্ত ভাড়া আদায় করা হয়। আসন্ন ঈদুল আযহাকে সামনে রেখে নতুন করে যাতে আবার ভাড়া না বাড়ানো হয় সেব্যাপারে প্রশাসনের কঠোর নজরদারি আশা করেন যাত্রীরা।
করোনার লকডাউনের আগে এখানে স্পিডবোটে ভাড়া নেয়া হতো ১৭০ টাকা, পাশাপাশি ট্রলারের যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া নিতো ১০০ টাকা। যদিও ফরিদপুর জেলা প্রশাসক এর ১২/০৮/২০১৮ইং তারিখের ০৫.১২.২৯০০.০১০.৯৯.০১৩.১৬-৩৩৩নং স্বারকের এক পত্রে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার(রাজস্ব ) মো. নুরুন্নবী স্বাক্ষরিত এক পত্রে চরভদ্রাসন মইনুট ফেরিঘাটে যাত্রী পারাপারের হার তথা তোলা/ভারা নির্ধারন করা হয় যাত্রী প্রতি স্পীড বোটে ১৬০টাকা এবং ট্রলারে ৮০টাকা এছাড়া ঘাটে ভাড়ার রেট চার্ট টাঙানোর পাশাপাশি দিনে ও রাতে একই ভারা নেওয়া এবং নৌযানে লাইসেন্স ও ফিটনেস সার্টিফিকেট রাখার নির্দেশ প্রদান করেন। এর পরে সরকারী ভাবে ভাড়া বাড়ানোর কোন চিঠি পাওয়া যায়নি। দিনে রাতে একই ভাড়া নেওয়ার নির্দেশনা থাকলেও সন্ধ্যার পর নদী পার হতে যাত্রীদের নিকট হতে কয়েকগুন বেশি ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে ঘাট মালিকদের বিরুদ্ধে।
জানা গেছে, গত বছরের ১৪এপ্রিল(পহেলা বৈশাখ বাংলা ১৪২৬ সাল) চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে ঢাকা বিভাগীয় অতিরিক্ত কমিশনার(রাজস্ব)অফিস হতে বিভিন্ন শর্ত সাপেক্ষে এক বছরের জন্য ৫ভাগ আয়কর ও ১৫ভাগ ভ্যাট সহ পঁাচ কোটি আটষট্ট্রি লক্ষ একানব্বই হাজার পঁাচশত টাকা পরিশোধ করে লীজ গ্রহন করেন জনৈক নুরুল ইসলাম পাটনি নামে এক ব্যাক্তি। নুরুল ইসলাম পাটনির নামে ঘাট ইজারা নেওয়া হলেও স্থানীয় আব্দুল সিকদারের ডাঙ্গী সরকারি প্রা:বি:শিক্ষক এস এম শাহীন আনোয়ার, ওয়াহীদুজ্জামান মোল্লা ও আলিমৃধা সহ কতিপয় প্রভাবশালীরা এই ঘাটটি নিয়ন্ত্রন করে। ইজারা চুক্তিপত্রে দেখা যায় লীজ গ্রহিতা ‘খথ তফশীলে বর্নিত অনুমোদিত হারে তোলা/ভারা আদায় করতে পারবেন এবং ঘাটের যাত্রীরা দেখতে পায় এমন স্থানে তোলার চার্ট সম্বলিত সাইনবোর্ড টাঙানো,নিজ ব্যায়ে ঘাট এলাকার পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করন, সাবলীজ প্রদান না করার কথা থাকলেও স্থানীয় কাজি বাড়ির ঘাটটি সাবলীজ প্রদান করে উপরে বর্নিত চুক্তি ভঙ্গ করে ঘাট পরিচালনা করছেন তারা।
ইজারাদার নুরুল ইসলাম পাটনির কাছে ঘাট সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান ‘তার নামের লাইসেন্স ব্যাবহার করে বর্তমান ঘাট মালিকরা ঘাট ইজারা নিয়েছেন বিনিময়ে তাকে সামান্য কিছু টাকা দিয়ে থাকেন।
উপরে উল্লেখিত অভিযোগের ব্যাপারে ঘাট পরিচালনার অন্যতম অংশীদার এসএম শাহীন আনোয়ার বলেন লকডাইনের পরে সরকারী নির্দেশনা মোতাবেক স্বাস্থ্যবিধি মেনে যাত্রী পারাপার করা হচ্ছে। প্রতিটি স্পিডবোটে ও ট্রলারে ধারন ক্ষমতার কম যাত্রী নেওয়া হচ্ছে, তাই ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। তিনি দাবী করেন তার প্রতিটি বোটেই লাইফ জ্যাকেট রয়েছে। কিন্তু ফিটনেস এর ব্যাপারে বলেন, আমরা আমাদের বোটের রেজিস্ট্রেশন ও ফিটনেসের জন্য নৌ পরিবহন অধিদপ্তরে যোগাযোগ করেছি, কিন্তু সরকারী ভাবে স্পিডবোটের ও ট্রলারের রেজিস্ট্রেশন ও ফিটনেস দেয়া হয়ে না বিধায় করতে পারি নি। সরকারী স্কুলের দায়িত্ব বাদ দিয়ে ঘাটে সময় দেয়ার অভিযোগ তিনি অস্বিকার করেন। যাত্রী হয়রানী ও অতিরিক্ত ভাড়া নেয়ার বিষয়টি অসত্য বলে দাবী করেন তিনি।
এসময় তিনি বলেন, স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের অন্যায্য দাবী মেনে না নেয়ার ব্যাক্তি আক্রোশে তারা ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে তাদের কাছ থেকে মোটা অংকের জরিমানা আদায় করেন।
এই বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জেসমিন সুলতানা ইত্তেফাককে বলেন, বর্তমান ঘাট মালিকদের বিরুদ্ধে ভাড়া বৃদ্ধি ও যাত্রী হয়রানির অনেক অভিযোগ রয়েছে। করোনা লকডাউনের ভেতরে ঘাটমালিকরা গোপনে ভাড়া বৃদ্ধি করে যাত্রী পারাপার করেছে। স্থানীয়দের মাধ্যমে খবর পেয়ে আমরা কয়েকবার মোবাইল কোর্ট করেছি। বাংলা ১৪২৭ সালে পূর্বের ঘাট মালিকরা ঘাট পেয়েছে কিন্তু ২০১৮ সালের পরে ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়ে নতুন কোন চুক্তি হয়নি। আমাদের মোবাইল কোর্ট অব্যাহত রয়েছে এর পরেও ঘাট মালিকরা নির্দিষ্ট টোল চার্ট না টাঙিয়ে ভাড়া বেশি নিলে উর্ধ্বতন কতৃপক্ষকে জানিয়ে এদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যাবস্থা গ্রহন করা হবে। ইউএনও আরো বলেন, ভাড়া বাড়াতে হলে, আগে স্থানীয় প্রশাসন সার্ভে রিপোর্ট দিবে, তার ভিত্তিতে ভাড়া নির্ধারণ হবে। স্থানীয় প্রশাসনের সাথে কোন আলোচনা ছাড়াই ঘাটের ইজারাদার ইচ্ছেমত ভাড়া বাড়িয়েছেন। তিনি জানান, করোনাকালীন লকডাউনের সময়েও তারা সরকারী নিশেধাজ্ঞা অমান্য করে যাত্রী পারাপার করেছেন।
ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক অতুল সরকার জানান, তদন্ত করে অভিযোগের সত্যতা পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। যাত্রী হয়রানী বন্ধ ও স্বাস্থ্যবিধি মানাতে প্রশাসন তৎপর রয়েছে। ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়ে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) মো. নুরুন্নবী ইত্তেফাককে বলেন, ২০১৮ সালের ভাড়া চুক্তির পরে আর কোন ভাড়া বাড়ানো হয়েছে বলে জানা নেই। আর ভাড়া বাড়াতে হলে আগে শংশ্লিষ্ট ইউএনও এবং জেলা প্রশাসক শুপারিস করলেই ভাড়া বাড়বে। ইজারাদার ইচ্ছেমত ভাড়া বাড়াতে পারবে না। এবং চুক্তি অনুযায়ী ভাড়ার চার্ট প্রকাশ্যস্থানে টাঙিয়ে রাখতে হবে।
ফরিদপুর ৪ আসনের সংসদ সদস্য মুজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন ইত্তেফাককে বলেন, ঘাটের অতিরিক্ত ভাড়া ও অনিয়মের বিষয়ে অনেকেই অভিযোগ দিয়েছেন। বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বলেছি। এমপি এসময় আরো বলেন, আমি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে এই রুটে ফেরী চালুর চেষ্টা করে যাচ্ছি, আমার রাজনৈতিক বিরোধী গোষ্টি জটিলতা সৃষ্টি করে সেটি চালু করতে দেয়নি। আশার কথা হলো, এই রুটে খুব শিগ্রী নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের ফেরী চলাচল শুরু হবে , তার আগেই চালু হবে সী ট্র্যাক। সে লক্ষ্যে রুট নির্ধারণ করে ইতিমধ্যেই ড্রেজিং এর কাজ শুরু হয়ে গেছে। এমপি আশাবাদ ব্যাক্ত করে জানান, সী-ট্র্যাক ও এর পরে ফেরী চালু হলে ঘাটে যাত্রী হয়রানী আর থাকবে না।
এমপিথর মত স্থানীয় জনসাধারণেরও আশা অচিরেই এই রুটে চালু হবে সী-ট্র্যাক, হয়রানী ও দুর্ভোগ লাঘোব হবে তাদের।
Leave a Reply