সততা আর শ্রম কখনও বিফলে যায় না
বিশেষ প্রতিনিধি:
বাংলাদেশের ব্যাটারির মান বেশ উন্নত। এটি এখন শিল্প খাত হিসেবে বিস্তৃত হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার সক্ষমতা রয়েছে দেশীয় ব্যাটারি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অত্যন্ত সুনামের সাথে রপ্তানি হচ্ছে বাংরাদেশে উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের ব্যাটারী। শুনতে সহজ মনে হলেও অনেকটা সময় নিয়ে ধীরে ধীরে আজকের এ অবস্থানে এসেছে খাতটি। এ অবস্থানে আসার পেছনে খাতসংশ্লিষ্ট মানুষ, কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও গ্রুপের বেশ ভূমিকা রয়েছে। এদের মধ্যে অন্যতম পান্না গ্রুপ। দেশে ব্যাটারি খাতের সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রটি তৈরির পেছনে পান্না গ্রুপের অবদান প্রথম সারিতে। বলা যায়, বাংলাদেশের ব্যাটারি খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে পান্না গ্রুপ।
পান্না গ্রুপের ব্যবস্থাপনা টিমের নেতৃত্বে রয়েছেন মো. লোকমান হোসেন। বাংলাদেশের ব্যাটারি শিল্পের পথিকৃৎদের একজন মো. লোকমান হোসেন। শিশুশ্রমিক হিসেবে ব্যাটারিশিল্পে প্রবেশ; এরপর ১৯৮০ সালে মাত্র সাড়ে তিন হাজার টাকায় কয়লার ব্যবসা দিয়ে শুরু। পরে গড়ে তোলেন সিসা পুনঃপ্রক্রিয়াজাত কারখানা। ধীরে ধীরে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তার কঠোর পরিশ্রম, সততা ও জবাবদিহির ফসল আজকের পান্না গ্রুপ। এ গ্রুপের প্রাণপুরুষ তিনিই। বর্তমানে তার গ্রুপে দেশি—বিদেশি প্রায় ৮ হাজার কর্মী রয়েছেন।
তিনি দেশের জনপ্রিয় ভলভো ব্র্যান্ডের ব্যাটারি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান পান্না গ্রুপের কর্ণধার ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ব্যাটারির পাশাপাশি সৌরবিদ্যুৎ ও পাট খাতেও পান্না গ্রুপের ব্যবসা রয়েছে। এবিষয়ে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ” দৈনিক গণসংহতি ” পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক মোঃ মনিরুজ্জামান মৃধা (মন্নু)
প্রতিবেদক ঃ কেমন আছেন?
মোঃ লোকমান হোসেন ঃ ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
প্রতিবেদক ঃ আমিও ভালো আছি। আপনার প্রতিষ্ঠান পান্না গ্রুপের শুরুর গল্পটা জানতে চাই
মোঃ লোকমান হোসেন ঃ আমি মাত্র আট বছর বয়সে ১৯৭২ সালে ফরিদপুর থেকে মামার সঙ্গে ট্রাকে চড়ে প্রথম ঢাকায় আসি। আমার বাবা ছিলেন কৃষক। স্বাধীনতার পরে মিথ্যা হত্যা মামলায় লড়তে গিয়ে আমার বাবা সর্বস্বান্ত হন। এ কারণে ওই বয়সেই জীবন—জীবিকার সন্ধানে ঢাকায় আসতে হয়। পুরান ঢাকায় আল মদিনা নামের একটি ব্যাটারি কারখানায় কাজ নিই। তারা সপ্তাহে ১০ টাকা ও খাবার দিত। কাজ শেখার পর মাসে ১৫০ টাকা বেতন পেয়েছি। কষ্ট হলেও আমি কাজ শেখার চেষ্টা করেছি; কয়েক বছর সেখানে কাজ করেছি।
প্রতিবেদক ঃ নিজের ব্যবসা শুরু এবং পুঁজি জোগাড় করলেন কীভাবে?
মোঃ লোকমান হোসেনঃ আমি ওই চাকরিটা ১৯৮০ সালে ছেড়ে দিই। সংসার আর নিজের ব্যয় মেটানোর পর তখন আমার কাছে সাড়ে তিন হাজার টাকা ছিল। সেটাকে পুঁজি হিসেবে নিয়েই ব্যবসা শুরু করি। এ টাকা দিয়ে তখন কোনো ব্যবসা করা সম্ভব ছিল না। তাছাড়া তেমন কোনো ব্যবসা আমি জানতামও না। ব্যাটারি কারখানায় সিসা গলানোর জন্য কয়লা ব্যবহার করা হতো। আমি ওই পুঁজি দিয়ে এবং কিছু টাকা দিয়ে বাকিতে কয়লা কিনে ব্যাটারি কারখানায় সরবরাহ করি। পুঁজি কম থাকায় বাকিতে কয়লা নিই। বিক্রি করে টাকা পরিশোধ করি। এভাবে এক বছরে হাতে কিছু টাকা জমে। ১৯৮১ সালে ব্যাটারির মূল কাঁচামাল সিসা গলিয়ে তা বিভিন্ন ব্যাটারি কারখানায় বিক্রি শুরু করি। এরপর ব্যাটারি কারখানা করার চিন্তা মাথায় আসে।
প্রতিবেদক ঃ এরপর………………………..
মোঃ লোকমান হোসেন ঃ ১৯৮২ সালে সীসা পুনঃপ্রক্রিয়াজাত কারখানা নির্মাণ করি। এরপর ধীেও ধীরে ব্যাটারী তৈরীর কারখানা করি। প্রথম মাসে আড়াইশো ব্যাটারি তৈরি করে বাজারজাত করি। এভাবেই পথচলা শুরু। শুরু থেকে ব্যাটারির গুণগত মান ঠিক রাখার দিকে নজর দিই। এতে বেশ কিছু গ্রাহক তৈরি হলো। তারপর জীবনে অনেক ঘাত—প্রতিঘাত এসেছে। ব্যবসায় বড় অঙ্কের ক্ষতির মুখেও পড়েছি। তবে হতাশ হইনি কখনো। ধৈর্য ধরে কাজ করেছি। আমার প্রথম জীবনের সহকর্মীদের অনেকে এখনো কোনো না কোনো কারখানায় কাজ করছেন। আর আল্লাহর অশেষ রহমতে আমার গ্রুপে এখন কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। দেশের বাজারে জনপ্রিয় ব্যাটারির নাম বললেই এখন পান্না গ্রুপের নাম চলে আসে।
প্রতিবেদক ঃ আপনার ব্যবসায় এগিয়ে থাকার মূলমন্ত্র কী?
মোঃ লোকমান হোসেন ঃ একজন মানুষ শ্রম ও সততা দিয়ে চেষ্টা করলে অবশ্যই সফল হবেন। আমি বিশ্বাস করি, মানুষের সততা আর শ্রম কখনও বিফলে যায় না। আর বড় হওয়ার জন্য ধৈর্যশীল হতে হবে। আমি যে ব্যবসা শুরু করেছিলাম, ধৈর্য ধরে এখনও সেটিতেই আছি। অনেক ঝড় এসেছে, পুঁজি হারিয়ে হাসতে ভুলে গিয়েছিলাম। তারপরও কাজ করে গেছি। কখনও থেমে থাকিনি। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, দু—চার টাকা বেশি লাভের আশায় কাউকে ঠকানো যাবে না। ফলশ্রম্নতিতে গ্রাহক আর কর্মীবাহিনীসহ সবার সহায়তায় সামান্য একজন কর্মী থেকে আজ শিল্পোদ্যোক্তা হয়েছি।
প্রতিবেদক ঃ শ্রমিক স্বার্থের কথা বলছিলেন, বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?
মোঃ লোকমান হোসেন ঃ কারখানায় শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের বিষয়টিকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়া হয়। তাদের জন্য কারখানায় সার্বক্ষণিক তিনজন চিকিৎসক রয়েছেন। শ্রমিকদের ক্যালরি নিশ্চিতে প্রতিদিন প্রত্যেক শ্রমিকের জন্য এক গ্লাস দুধ, একটি ডিম, দুই পিস পাউরুটি ও একটি কলা সমন্বয়ে নাস্তা দিই। কর্মীদের জন্য প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশের একটি অংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়। যে বছর যেমন লাভ হয়, সে বছর সে হারে কর্মীদের ‘প্রফিট বোনাস’ দেওয়া হয়। আমার প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৮ হাজার কর্মী আছেন। আমি তাদেরকে আমার পরিবারের সদস্য, আমার সন্তান বলেই মনে করি। আজ আমি বেশ ভালো জীবনযাপন করছি। এর মূল কারিগর আমার প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা। সুতরাং তাদের ভালো রাখা আমার দায়িত্ব। একসময় আমি নিজেও শ্রমিক ছিলাম, তাদের কষ্টটা অনুভব করি।
প্রতিবেদক ঃ আপনার তো ব্যাটারী ব্যবসায়ে হাতেখড়ি, তাহলে জুটি মিল কিভাবে প্রতিষ্ঠা করলেন ?
মোঃ লোকমান হোসেন ঃ ব্যাটারিই আমার মূল ব্যবসা। আমার জন্মস্থান ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার পরিক্ষীতপুর গ্রামে। স্থানীয় অধিবাসীরা কর্মসংস্থানের জন্য আমার কাছে এস বলে একটা কাম দাও বেকার আছি। কিন্তু প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতা না থাকায় আমি তাদেরকে ব্যাটারি কারখানায় কাজের সুযোগ দিতে পারছিরাম না। সেই অপূর্ণতা থেকে নিজের জন্মভিটার পাশে গড়ে তুলি আলতু খান জুট মিল। এখানে প্রায় ৪ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। বৈশ্বিক মন্দা ও আন্তর্জাতিক বাজার নিম্নমুখী হওয়ায় বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক না হলেও কর্মরতদের স্বার্থেই প্রতিষ্ঠানটিকে আজ পর্যন্ত সচল রেখেছি।
প্রতিবেদক ঃ এবার একটু ভিন্ন প্রশ্ন করি। আপনি কি কোন দলের রাজনীতি করেন বা কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী কি না ?
মোঃ লোকমান হোসেন ঃ প্রশ্নটি করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আসলে আমি ব্যবসা করি, ব্যবসা নিয়েই ব্যস্ত থাকি। রাজনীতি নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার মত সময় আমার নেই। আমি কোন দলের রাজনীতি অতীতে করি নাই, এখনো করি না। কখনো রাজনীতি করার চিন্তাও করি না। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো সামপ্রতিক সময়ে কেউ কেউ আমার ভাবমূর্তির্ বিনষ্ট করার উদ্দেশ্যে এই বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে মিথ্যা অপপ্রচার করছে যা একেবারেই মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। আমি এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।
প্রতিবেদক ঃ নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য আপনার পরামর্শ…
মোঃ লোকমান হোসেন ঃ কোনো ব্যবসা করতে হলে আগে সে সম্পর্কে ভালো করে জানতে হবে। সেটি ওই খাতে চাকরি করেও হতে পারে। অন্য যে কোনো উপায়েও হতে পারে। একটি ব্যবসা সম্পর্কে না জেনে সেখানে বিনিয়োগ করলে হেঁাচট খাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই না জেনে—বুঝে বিনিয়োগ করে কোনো ব্যবসায় সফল হওয়া যায় না। এরপর বলব, হঠাৎ করে বড় কিছু না করে ছোট আকারে শুরু করা ভালো। এতে ঝুঁকির শঙ্কা কম থাকবে। অভিজ্ঞতার সঙ্গে ব্যবসার পরিধি বাড়লে সেটা সব দিক দিয়ে ভালো।
প্রতিবেদক ঃ আমাদেরকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
মোঃ লোকমান হোসেন ঃ আপনাকেও ধন্যবাদ।
Leave a Reply